ধ্রুব

 

লেখিকাঃ- দীপালি ভট্টাচার্য

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------




জন্ম থেকেই বাবার আদর পায়নি ধ্রুব। বাবা না থাকা এক জিনিস, কিন্তু থেকেও যদি তিনি সন্তানের প্রতি উদাসীন থাকেন সে কষ্ট সহ্য করা যায় না।
      
ধ্রুব জন্মাবার পরেই ওর মা মারা যান। সেইদিনই পরিবারে আর একটি দুর্ঘটনা ঘটে। পিসি কোমল তার স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে বাপের বাড়ি আসছিলেন। পথ দুর্ঘটনায় পিসেমশাই আর তাঁদের একমাত্র সন্তান মারা যান। এই শিশুটি যেন দুর্যোগ মাথায় নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। এরপর থেকে তার বাবাও সন্তানের প্রতি বিমুখ হয়ে ওঠেন। তবু পিসি শিশুটিকে ফেলে দিতে পারেননি। শোক তাপ ভুলে তিনিই কোলে তুলে নিয়েছিলেন শিশুটিকে।
  
ধ্রুব যখন বছর পাঁচেক তখন তাদের সংসারে নতুন মা এলেন। যদিও ধ্রুব তার পিসিকেই মা বলে জানে। পিসিও ধ্রুবকে খুব ভালোবাসেন। পিসি তার দাদার কাছে মাঝে মাঝে অনুযোগ করেন, "আমার বাছাটাকে তো মাঝে মাঝে কোলেও নিতে পারিস?"

সত্যিই ধ্রুব কোনদিনই তার বাবার কোল পায়নি। সে তার বাবার কাছে গেলে তার বাবা সরে যান। যত বড় হতে থাকে ততই এই দুঃখ ধ্রুবকে গ্রাস করে ফেলে। পিসি তাকে মায়ের অভাব কোনদিন বুঝতে দেন নি। কিন্তু বাবার অভাব পূরণ করবে কে? নতুন মা  আসার পর বাবার সাথে ধ্রুবর দূরত্ব আরো বেড়ে যায়। সব দেখে শুনে কোমল নীরবে চোখের জল ফেলেন।

"পিমা, বাবা আমাকে ভালোবাসে না কেন? বাবা তো ভাইকে কত আদর করে, আমাকে আদর করে না কেন?" পিসিমা কে পিমা বলেই ডাকে ধ্রুব। এদিকে ধ্রুবের এই সহজ সরল প্রশ্নের কি উত্তর দেবেন কোমল ভেবে ভেবে দিশেহারা হয়ে যান। তিনি বলেন, "তুমি দেবী সরস্বতীর আরাধনা কর। তবেই তুমি বাবার ভালোবাসা পাবে। তুমি লেখাপড়া শিখে এত বড় হও, এত বড় মনের মানুষ হও যাতে তোমার বাবা কখনোই তোমাকে অবহেলা করতে না পারেন!"

পিমা কখনো ভুল কথা বলেন না, এটা ধ্রুব বিশ্বাস করে। সে তাই রোজ পড়তে বসার আগে দেবী সরস্বতীর স্তব করে পড়তে বসে। "শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেত পুষ্পোপশোভিতা।....."
    
ধ্রুব আজকাল লেখাপড়ায় বেশ উন্নতি করেছে। একটা সময় ছিল ও একদম মন দিয়ে পড়াশোনা করত না। সবসময় উদাস থাকত, আর কি যেন ভাবত! তখন কেবলই অঙ্ক, ব্যকরণ এসব ভুল করত। পিমা তাকে কালিদাসের গল্প শুনিয়েছেন। কিভাবে তিনি মূর্খ কালিদাস থেকে মহাকবি কালিদাস  হয়েছেন পিমার মুখ থেকে সে গল্প শুনতে শুনতে তার মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। পিমা তাকে পুরাণের ধ্রুবর গল্প বলেছেন। সেই ধ্রুবও ছোটবেলায় বাবার স্নেহ পাননি। কিন্তু নিজ গুনে তিনি একদিন অনেক বড় হয়েছেন। সেও ভাবতে থাকে, কবে সে নিজ গুনে বাবার কোলে ঠাঁই পাবে। ছোট ভাই উত্তমকে বাবা যেভাবে ভালোবাসেন তেমন করে তাকে ভালোবাসবে কবে?
 
ধ্রুবর বাবা ইদানিং তার দিদি কোমলের  কাছ থেকে ধ্রুবর পড়াশোনার ব্যাপারে খোঁজ খবর নেন। ধ্রুব জন্মাবার পরেই বাড়িতে এত অঘটনের ফলে ছেলের থেকে তিনি দূরে সরে যাওয়ার পর এখনও ছেলের সাথে  তিনি কথা বলেন না।

উত্তমের পাঁচ বছরের জন্মদিনে সে অনেক উপহার পেয়েছে। ব্যাট বল, বেলুন, কত কি! নতুন মা একটাও ধ্রুবকে ধরতে দেননি। ধ্রুব মন খারাপ করলে পিমা তাকে ব্যাট বল কিনে দেন। ধ্রুবের বয়স বারোও হয়নি, বায়না তো করবেই!
    
সেদিন হয়েছে কি পিমা গেছেন ব্যাঙ্কের কাজে, আর নতুন মা স্নান করতে কলঘরে। এদিকে কাজের মেয়ে কাজ করে চলে যাবার পর সদর দরজা আর বন্ধ করা হয়নি। এই ফাঁকে উত্তম যে কখন বল হাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে  রাস্তায় চলে এসেছে কেউ দেখেনি। ধ্রুব গিয়েছিল স্কুলে। সেদিন তার ফাইনাল পরীক্ষার শেষ দিন। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিল সে । হঠাৎ তার চোখে পড়ে উত্তমের হাত থেকে বলটা গড়িয়ে রাস্তার ওপারে চলে যাচ্ছে। সেই বল নিতে সে রাস্তা পেরোবার চেষ্টা করছে। এই সময় তীর বেগে একটা লরি ধেয়ে আসে উত্তমের দিকে। তাই দেখে রাস্তার লোকজন চিৎকার করতে শুরু করল। গেল গেল রব ওঠে। দূর থেকে ধ্রুব দেখেছে সবই। সে ছুটে এসে কোনরকমে ভাইকে কোলে নিয়ে ফুটপাতে লাফ দিল। আর লরিটিও হুঁশ করে বেড়িয়ে যায় পাশ দিয়ে। ভয়ে ধ্রুব জ্ঞান হারায়।
  
যখন জ্ঞান ফেরে তখন ধ্রুব দেখে, তার বাবার কোলে মাথা দিয়ে সে শুয়ে আছে। তার অনেক চোট লেগেছে, সারা শরীরে খুব ব্যথা। তার নতুন মা গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। সে বলল, "পিমা কোথায়?" পিমা মাথায় ঠাকুরের ফুল ছুঁইয়ে বললেন, "এই তো বাবা, আমি এখানে"।  



মন্তব্যসমূহ

এই ওয়েবজিনের জনপ্রিয় নিবন্ধঃ-

বিজ্ঞপ্তি

ছোটদের ফটোগ্রাফি শেখা - পর্ব ১ (শ্যাডো প্লে)

হাড় মজবুত করতে চাও? তাহলে রোজ শশা খাও!

ভারতমাতা