অর্ঘ্য - পর্ব ২

 

লেখকঃ- সঞ্জিতকুমার সাহা

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------



    
পুলকেশ দোতলার যে ঘরে বসেন সেখান থেকেই দেখা যায় অসীমবাবুর বাগানের পুরো ছবি। ওই তো স্কুলের গা ঘেঁষে, একেবারে পাঁচিলের গায়ের কাছেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি বাতাবি লেবুর গাছ। সেখানে ঝুলছে অসংখ্য বাতাবি লেবু। দিনে দিনে বড়ো হচ্ছে। একেকটা ছোটোখাটো ফুটবলের মতো। এরপরে আতা গাছে আতা, বেল গাছে বেল। ডালিম গাছেই তো কত ডালিম। দেখলে কার না লোভ হয়! আর ওরা তো বাচ্চা। ওরা ওই বাতাবি পেড়েই বা কী করবে! খেতে পারত? কিন্তু ওরা যে সেদিন বাতাবিই পেড়েছিল তার প্রমাণও মিলেছে। দুদিন আগে দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে বাতাবির খোল পড়ে থাকতে দেখা গেছিল। তার মানে ওটা ওই বাগানেরই লেবু ছিল। সেদিন কিছু মনে হয়নি। মনে হয়েছিল কেউ হয়তো বাড়ি থেকে এনে বন্ধুরা মিলে মজা করে খেয়েছে। তারই দু-চারটি খোল হয়তো পড়ে ছিল। আজ মনে হচ্ছে, ওগুলো ওই বাগানেরই ছিল। কিন্তু এই অপকর্ম কে বা কারা করেছে তা জানা যায়নি, পুলকেশ জানতেও চাননি।
    
পুলকেশ ভাবতে থাকেন, অসীমবাবু যদি সত্যি ধরে আনত ছেলেদুটোকে? তাহলে কী কেলেংকারিটাই না হত! ছেলেদুটোও তো লজ্জায় মরে যেত। সবাই ওদের লেবু চোর বলত। এসব শুনতে পুলকেশের ভালো লাগত! মোটেই না। তিনি বাতাবিগুলোকে দেখলেন, এখনও তো গাঢ় সবুজ। মানে পরিপক্কই হয়নি। ঠিকঠাক পাকতে এখনও এক দেড় মাস লাগবেই। তার আগে পেড়ে কি লাভ? ওই ছেলেপুলেদের মজা। 
   
পুলকেশ ভাবলেন, এ নিছকই কিশোর বয়সের মজা বা আমোদ। হয়তো এটাই এদের কাছে আনন্দ বা বিনোদন। কিন্তু যিনি বাগান করেছেন, যিনি নিজের হাতে এসব গড়েছেন, যিনি সন্তান স্নেহে গাছগুলোকে একটু একটু করে বড়ো করে তুলেছেন তিনি এসব মানবেন কেন? প্রতিটি গাছের জন্য তিনি যে যত্ন করেন সে তো পুলকেশ ঘর থেকে লক্ষ্যও করেন। কাঁচা জিনিস ছিঁড়লে তাই কার না কষ্ট হয়! 

    
এর মধ্যে একদিন হাটে পুলকেশের সঙ্গে অসীমবাবুর দেখা। সেদিন তো তিনি একেবারে অন্যরকম, "সার আমার নিজের হাতের উচ্ছা (উচ্ছে), একটুক নিয়া যান সার।"
    
"কত করে?"
    
অমনি অসীমবাবু এক হাত জিভ বের করে বললেন, "কী যে বলেন সার! আপনার কাছে দাম নিব?" বলে আরও বললেন, "সার আমরা চাষাভুষা মানুষ। আপনেরা মহানজন। নিখাপড়ার মানুষ। আমাদিগের পোলাপানদের কত কী শিক্ষা দিতেছেন! কত দূর থেকে আইছেন। আপনার নিকট কিছু লওয়া যাবে না। এই ন্যান ধরেন।" বলে একরকম জোর করে খানিক উচ্ছে আর খানকতক শশা পুলকেশের থলেতে একরকম জোর করে ভরে দিয়েছিলেন। 

পুলকেশ না করতে পারেননি। শুধুমাত্র সৌজন্য সম্মানের জন্য, না নিলে এখানকার মানুষ নিজেদের অসম্মানিত বা অপমানিত বোধ করেন তাই নেওয়া। 
    
সেই থেকে পুলকেশের সামনে অসীমবাবু পড়ে গেলেই পুলকেশকে সম্মানে ভরিয়ে দিত। 
    
শুধু অসীমবাবুই নন, এই এলাকার যে কেউ পুলকেশকে দেখলেই নমস্কার বা পেন্নাম হই মাস্টর বলে গদগদ হয়ে যান। এই সম্মান কলকাতায় থাকলে কখনও পেতেন! বাসে উঠলে বসার জায়গা খুঁজতে হয় না। কেউ না কেউ এগিয়ে এসে নিজের জায়গা খালি করে দিয়ে বলে, "বসেন মাস্টার। বসেন।" 
   
প্রথম প্রথম ভদ্রতায় লাগত। কিন্তু এটা এখানে দস্তুর। আপনি না বসলে তিনি অসম্মানিত বোধ করেন। এখানকার সভ্যতা-ভদ্রতা, সম্মান এরকমই। 
    
অথচ অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পাওয়ার পরে এখানে আসার কথা শুনে পুলকেশ প্রথমে যে খুব খুশি হয়েছিল বলা যাবে না। বরং উলটে খুব হতাশ হয়ে পড়েছিল। কোথাকার কোন ধ্যারধেরে গ্রাম -– সেখানে যেতে হবে? ভাবতেই পারছিল না। তারপর বাড়ির জন্যই এমনকি সকলের পরামর্শ মতো শিক্ষা দপ্তরে গিয়ে সচিবের সঙ্গে দেখাও করেছিল। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। 

উলটে সচিব বুঝিয়েছেন, "আপনারা এসএসসি দিয়ে চাকরি পেয়েছেন। নি:সন্দেহে আপনারা লেখাপড়ায় ভালো, মেধাবী ছাত্র। আপনাদের রেজাল্ট দেখেই নিয়োগ-নীতিতে ঠিক করা হয়েছে, ভালো ভালো স্টুডেন্টদের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়ার। এতে সামগ্রিকভাবে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি হবে সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যেই আমরা রেজাল্ট পেতে শুরু করেছি। এর আগে কেউ কখনও মাধ্যমিকে প্রথম দশজনের মধ্যে বাঁকুড়ার রাইপুর কিংবা মুর্শিদাবাদের জলঙ্গীর নাম শুনেছেন? এখন শুনছেন। আমরা আশা করব আপনি যেখানে যাবেন সেখানেও এমনই উন্নতি হবে।" 
    
কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। ও আসার আগে মাধ্যমিকে যে দু-চারজন বসত তাদের বেশিরভাগই ফেল করত অথবা পাশ করলেও থার্ড ডিভিসন, কোনোমতে টেনেটুনে। কিন্তু পুলকেশ আসার পরে পরেই আরও দুজন বাইরে থেকে এসেছেন। একজন সুপ্রভাত। আরেকজন বিজয়েতা। এরা আসার পর থেকে এই স্কুলের সুনাম বৃদ্ধি হতে শুরু হয়েছে। এই তো গত বছরেই এই স্কুল থেকে পঞ্চান্ন জন পরীক্ষা দিয়েছিল। একজনও ফেল করেনি। স্টার পেয়েছে দুজন। ফার্স্ট ডিভিসনেই বেশি। বিয়াল্লিশ জন। বাকিরা থার্ড ডিভিসনে। 
    
এলাকাটা অত্যন্ত দরিদ্র। বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই পরিবারের প্রথম পড়ুয়া। মা-বাবা লেখাপড়ার ধার দিয়েও যান না। অধিকাংশই কৃষিমজুর। তাঁরা ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠান মিড-ডে মিলের জন্য। স্কুলে গেলে অন্তত একবেলার খাওয়াটা জুটে যায় এই আশায়। ছেলেমেয়েগুলোও তাই আসে রোদ-বৃষ্টি-জলকাদা উপেক্ষা করে। 
    
দপ্তর থেকে যে টাকা মিড-ডে মিলের জন্য আসে তাতে কোনোমতে ডিম ভাত বা খিচুড়ি হয়তো হয়। আগে তাই হত। কিন্তু পুলকেশ আসার পরে, অল্পদিনের মধ্যেই ওর উদ্যোগেই টিচারদের অনুদান নিয়ে সপ্তাহে এক-দুদিন অন্যরকম খাওয়ার ব্যবস্থাও হয়েছে। কোনোদিন মাছ, কোনোদিন ছেলেমেয়েদের মাংসও খাওয়ায়। ইচ্ছে আছে, এরপর ফলটল দেওয়া যায় কিনা! 
    
শুধু বললেই তো হল না। ছেলেমেয়ের সংখ্যাও দিনে দিনে বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় সাতশো। এতগুলো ছেলেমেয়েকে খাওয়ানো সহজ ব্যাপার নয়। শুধু মিড-ডে মিলের জন্যই আলাদা ব্যবস্থাপনা। আলাদা ঘর। আলাদা লোক। 
    
পুলকেশের ইচ্ছে আছে, পুজোর ছুটির আগে ছেলেমেয়েদের একটা গ্রান্ড ভোজ দেবেন। ডাল-ভাত-মাংস তো হবেই, শেষ পাতে ফল ও মিষ্টি। পুজোর উপহার। টিচারদের এজন্য প্রস্তুত থাকতেও বলেছেন। সবাই রাজি। 

     
স্কুল ছুটি হতে আর মাত্র দুদিন বাকি। ছেলেমেয়েরাও জেনে গেছে, ছুটির দিনে জোর খাওয়াদাওয়া হবে। সেজন্য এখন স্কুলে আসা বন্ধ নেই কারুর। উপস্থিতির হার এখন প্রায় একশো শতাংশ। পুলকেশ সমস্ত ব্যাপারটা সুপ্রভাত ও বিজয়েতার উপরে ছেড়ে দিয়ে বলেছেন, সব যেন সুষ্ঠভাবে হয়। 
    
ঠিক এমন সময়ে, সুভাষ নামের একটি ছেলে, ওদের স্কুলেরই প্রাক্তন ছাত্র, গত বছর পাশ করে এখন উচ্চ-মাধ্যমিক পড়তে ইটাহারের স্কুলে গিয়েছে -– সে এসে পুলকেশের হাতে খামে ভরা একটা চিঠি দিয়ে বলল, "স্যার জ্যাঠামশায় দিলেন।"
    
"জ্যাঠামশায় কে?" 
    
"স্যার অসীম বিশ্বাস আমাদের জ্যাঠামশায়। তিনিই এই চিঠি পাঠিয়েছেন।" 
    
অসীম বিশ্বাস! মানে স্কুল লাগোয়া এই বাগানের মালিক! 
    
চিঠির কথা শুনেই শঙ্কা জাগে মনের ভিতরে। আবার কিছু হল নাকি! কি করেছে ছেলেরা? মনের ভিতরে একটা খোঁচা খান আচমকাই। দুরুদুরু বুকে খামটা খোলেন। তারপর চিঠিটা পড়েই অবাক হয়ে যান। অসীমবাবু চিঠিতে লিখেছেন, 
    

শ্রদ্ধেয় হেডমাস্টারমশায়,
    
সামনেই পুজো। ছুটির আগে তাই কয়েক বস্তা পাকা বাতাবি লেবু ফল হিসেবে পাঠালাম। আমার ক্ষুদে দেব-দেবীর জন্য আমার সামান্য অর্ঘ্য। নিয়ে বাধিত করবেন।
   
বিনীত 
    
অসীম বিশ্বাস। 
    

পুলকেশ চিঠিটার দিকে এক দৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। এ যেন অনেকটা শরতের মেঘহীন সকালের এক মুঠো রোদ্দুর, অসীমবাবু সেই রোদ্দুর খামে ভরে পাঠিয়েছেন। ভাবতেই আশ্চর্য এক নির্মল হাসি মনের মধ্যে খেলা করতে থাকল। 




মন্তব্যসমূহ

এই ওয়েবজিনের জনপ্রিয় নিবন্ধঃ-

বিজ্ঞপ্তি

ছোটদের ফটোগ্রাফি শেখা - পর্ব ১ (শ্যাডো প্লে)

হাড় মজবুত করতে চাও? তাহলে রোজ শশা খাও!

ব্যাং রাজকুমারী - পর্ব ১