অর্ঘ্য - পর্ব ১

 

লেখকঃ- সঞ্জিতকুমার সাহা

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------



এমন যে একটা কাণ্ড ঘটতে পারে পুলকেশ ভাবতেও পারেননি। এখানে এই স্কুলে কাজ করাও তো দেখতে দেখতে সাত-আট বছর হয়ে গেল। এরকম ঘটনা এর আগে কখনও ঘটেনি। কিন্তু এবারে ঘটল। তাও আবার টিআইসি হওয়ার পরে পরেই। 

স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা-হেডমাস্টার অম্বিকেশ পাল মহাশয় সম্প্রতি অবসর নেওয়ায়, স্কুল কমিটি পুলকেশকেই টিচার্স-ইন্‌-চার্জ করেছে। কারণ ওর চেয়ে বেশ কয়েকজন বয়সে প্রবীণ হলেও  তুলনায় ওরই ডিগ্রি সবচেয়ে বেশি। দুটো বিষয়ে এমএ, বিএড ও এমফিল। এছাড়া ওর অমায়িক ব্যবহার, সকলের সঙ্গে সহজে মিশতেও পারে। সংস্কৃতিমনস্ক ও রুচিবান মানুষ। পড়ানও ভালো। ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়।
 
অথচ এখানে, এত দূরে আসতে প্রথমে খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে ওর মা, মা তো ছাড়তেই চাইছিলেন না। মা বলেছিলেন, এটা ছেড়ে দে। কলেজ সার্ভিসে পরীক্ষা দে। কিন্তু মা তো জানেন না যে কলেজে এখন পিএইচডি ছাড়া চলে না। ওরও ইচ্ছে ছিল পিএইচডি করার। কিন্তু হঠাৎ করেই মাথার উপর থেকে ছাতাটা সরে যেতেই ওকে এসএসসিতে বসতে হয়েছে। ছাতা মানে ওর বাবা, সংসারের একমাত্র যিনি রোজগেরে ছিলেন। তারপর থেকে তো এখানেই। গোড়ার দিকে অসুবিধে হলেও এখন এই জায়গাটাকেই পুলকেশ ভালোবেসে ফেলেছে।
  
জায়গাটা হদ্দমুদ্দ গাঁ-গেরাম বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই, কিন্তু এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এক কথায় অতুলনীয়। যেদিকে তাকাও সেদিকেই সবুজ, সবুজ আর সবুজ। সবুজের সমারোহ যাকে বলে তাই। এত সবুজ পুলকেশ আগে এভাবে কখনও দেখেইনি। চারপাশে শুধু সবুজের উচ্ছ্বাস, সবুজের বন্যা। 
    
এখানে যেমন জলকাদা আছে, তেমনি আছে ধুলোমাখা পথ ও পথের দুধারে সবুজ গাছপালা। আছে বকুল জারুল গাছের পাতার ফাঁকে নাম না জানা পাখির সুরেলা ডাক। আর আছে উড়ে বেড়ানো চঞ্চল প্রজাপতি। তেমনি আছে ঝাঁক বেঁধে পাখিদের ডানা মেলে ওড়ার আশ্চর্য আনন্দ। এখানে না এলে এমন ঝকঝকে সুনির্মল আকাশ, এমন একটা প্রাণময় পৃথিবী যে আমাদের পৃথিবীতেই আছে তাই পুলকেশ জানতে পারত না। আর আছে একটা নদী। নদীর দুই পাড়ে বালির ঢাল, আর পাড় জুড়ে গাছ। গাছ আর পাখি। পাখি আর গাছ। আলো আর বাতাস। তিরতির করে বয়ে চলা জলের স্রোত। মাঝেমধ্যে মৃদুমন্দ ঢেউ। এমন আশ্চর্য জায়গা সত্যি এর আগে পুলকেশ দেখেনি। 
    
স্কুলের টিচার্স রুম থেকেই দেখা যায় প্রকৃতির নানা রূপ। খানিক দূরের নদী। পুলকেশ এখানে এসেই গাছ চিনতে শিখেছে। কত রকমের যে গাছ এখানে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া, অর্জুন, বকুল, দারুচিনি, তেজপাতা, ডালিম, কাঁঠাল, আম-জাম-লিচু। তাল-খেজুর তো যেখানে সেখানে। তালগাছে বাবুই পাখির বাসাই শয়ে শয়ে, ডুমুর গাছে টুনটুনি, পুকুরে পদ্ম। পুলকেশ আগে একসঙ্গে গাছগাছালির এত বৈচিত্র্য কখনও দেখেনি, এখানে এসেই প্রথম দেখল। যেমন দারুচিনি, যেমন তেজপাতা। সব মিলিয়ে এই জায়গাটা যেন এক প্রকৃতির পাঠশালা। যে একবার এখানে আসবে তাকে এই জায়গাটাকে ভালোবাসতেই হবে। এমনই এক আকর্ষণ! 


এই তো একেবারে স্কুলের গা ঘেঁষেই রয়েছে পাঁচিল ঘেরা অসীম বিশ্বাসের বিশাল বাগান। পুলকেশের ধারণা বিঘা তিন-চারের বাগান তো হবেই, তার বেশিও হতে পারে। কী গাছ নেই সেখানে! যেমন আছে বড়ো গাছ তেমনি আছে মাঝারি এবং ঝোপঝাড়ও। তবে আম-কাঁঠালের গাছ বেশি নেই। ওগুলোতে নাকি বানর, হনুমানের উৎপাৎ বেশি হয়। এদিকে হনুমানেরা যখন আসে তখন দল বেঁধে, ঝাঁকে ঝাঁকে আসে। বাচ্চা, বুড়ো জোয়ান সবাই একসঙ্গে আসে। এমনকি এক্ক্বেবারে দুধের শিশুটিকেও মা-হনুমান কোলে করে বয়ে নিয়ে আসে। তখন রীতিমতো সমস্যা। হুসহাস করলেও যায় না, সহসা পালায়ও না। উলটে তেড়ে আসে। তখন পটকা ফাটাতে হয় অথবা আকাশের দিকে তাক করে গুলি ছুঁড়লে সেই আওয়াজে চলে যায়। অসীম বিশ্বাসের একটা গাদা বন্দুক আছে এই কারণে। এছাড়াও বগানেই একটা মাচা করা আছে, তার উপরে ঝোলানো আছে একটা খালি টিনের বাক্স। সেখানে এমন ব্যবস্থা করে রেখেছেন যে নিচে থেকে দড়ি ধরে টানলেই খুব জোরে জোরে টংটং শব্দ হতে থাকে। তখন ঝুপঝাপ পালায়। এমনটা হয় দুটো একটার ক্ষেত্রে। কিন্তু পাল পড়লে তখন বন্দুকের আওয়াজ ছাড়া নড়ে না। 
    
অসীমবাবুর বাগানের ঝোপজঙ্গলেও নানারকম ফল। করমচা, বনকুল, আতা, তেলাকুচা – এগুলো পাঁচিলের ধারে বেড়ার গাছ হিসেবে এমনিই হয়ে আছে। সেখানেও ফল খেতে আসে নানারকম পাখি। সব পাখির নাম এখনও জানে না পুলকেশ। তবে বুলবুলি, দোয়েল, টুনটুনি, ঘুঘু, সাতভাই, ছাতারে এসব চিনেছে। এরা পাকা ফল দেখলেই টুকটুক করে ঠুকরে খায়। সেজন্য অসীমবাবুকে বাগানেই অনেকটা সময় কাটাতে হয়। 

   
এছাড়াও বাগানের মাঝখানে আছে একটি ছোট্ট পুকুর। পুকুর না বলে ডোবা বলাই ভালো। আসলে বৃষ্টির জল ধরে রাখা হয় এখানে। সেই জলে ঘরের জন্য শাকসবজিও করেন, উদ্বৃত্ত হলে হাটে তোলেন। এই তো দড়ির মাচায় বিস্তার করেছে বরবটি, পুঁই, উচ্ছে, চিচিঙ্গে। আবার ঠিক তার নিচেই লাল শাক, ধনে পাতা, ব্রাহ্মী শাক ইত্যাদি। এতটুকু জায়গা নষ্ট করেন না। সবচেয়ে মজার কথা উনি নিজে হাতে সবগুলো গাছের পরিচর্যা করেন। ঘরের খেয়ে সবজি উদ্বৃত্ত হলে হাটে তোলেন। আর হাটে তোলা মাত্র সব শেষ হয়ে যায়। কারণ এলাকার সবাই জানে, তিনি যা করেন সবই নিজের হাতে তৈরি সার দিয়ে। সারের দোকানে তিনি যান না। গাছে পোকামাকড় হলে নিমপাতা জলে ফুটিয়ে স্প্রে করেন। সেজন্য তাঁকে হাটে দেখলে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে, মুহূর্তে সব বিক্রি হয়ে যায়। এখানে শুধু এই গ্রামের লোক নয় ওনাকে চেনে আশপাশের অন্তত দশ-বিশ গাঁয়ের মানুষ। 
    
তো সেই অসীমবাবু সহসা হাঁফাতে হাঁফাতে এসে সটান পুলকেশের ঘরে গিয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন, "এই শিক্ষা দিচ্ছেন ছেলেমেয়েদের?" 
    
"কেন কি হয়েছে?" আচমকা প্রশ্ন শুনে একটু ঘাবেড়েও যান পুলকেশ। 
    
"আরে মশায়, আমার বাগান থেকে আগে এমন খোয়া যেত না। ইদানীং ফল-পাকুড় চুরি হয়েই চলেছে। আমি তো আজ…"
    
কথা শেষ করতে পারেন না, হাঁফাতে থাকেন। সেটাই স্বাভাবিক। বয়স্ক মানুষ। 
    
"কী হয়েছে বলবেন তো!" পুলকেশ তাকিয়ে দেখলেন, বাগানের মালিক অসীম বিশ্বাস দরদর করে ঘামছেন। খালি গা। অবিন্যস্ত চুল ও চেহারা। পরনে লুঙ্গি। ঘাড়ে গামছা। ঘনঘন ঘাম মুছছেন। পুলকেশ সামনের খালি চেয়ার দেখিয়ে বললেন, "বসুন। একটু হাওয়া খান। তারপর ধীরে সুস্থে বলুন। কি হয়েছে, কেন এভাবে এখানে ছুটতে ছুটতে এসেছেন?" 
     
অসীমবাবুও বলবেন কী বলবেন না, অথবা কিভাবে বলবেন ভেবে নিয়ে, কিঞ্চিৎ স্থির হয়ে ধীরে ধীরে বলতে থাকলেন, "আজ তো একেবারে হাতেনাতে দুটোকে প্রায় ধরে ফেলেছিলাম কিন্তু ফসকে পালিয়ে গেল। না হলে বমাল ওদের ধরে টেনে এনে এখানে হাজির করতাম।"
    
পুলকেশের বুঝে নিতে সময় লাগল না। ওর স্কুলের কেউ বা কেউ কেউ ওর বাগানে ঢুকেছিল। নিশ্চয় গাছের ফলটল পেড়েছে বা পাড়ছিল। আর তখনি অসীমবাবুর নজরে পড়েছে। তাই পুলকেশ অসীমবাবুর দিকে নম্রভাবে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, "আপনি দেখলে চিনতে পারবেন?" 
    
"সে কী আর চিনতে পারব! তার উপরে চোখে ছানি পড়েছে। সামনের শীতে কাটাব। তবে দুটো নয়, অনেকেই ছিল। আমি উত্তর দিকে পেয়ারার গাছগুলোর কাছে গিয়ে ওদের যত্নয়াত্তি করছিলাম ঠিক এমন সময়ে হই হই, বেশ জোরের সঙ্গে কথাবার্তা, এটা পাড় ওটা পাড়। ওটা তোর হাতের নাগালে। একজন পাড়ছে, ডাল ভাঙছে আর কজনে নিচে দাঁড়িয়ে কুড়োতে যাবে, ঠিক এমন সময়ে কে-এ-রে-এ চিৎকার করতেই টপাটপ পাঁচিল টপকে সব হাওয়া আর যে দুটো গাছে উঠেছিল ওরা নামতেই আমি ওদের ধরে ফেলি।"
    
"তারপর?" উৎসুক ও কৌতূহলী দুই-ই হন পুলকেশ। 
    
"তারপর সার (স্যার)," বলে মুখ নিচু করে বলতে থাকলেন, "আমাকে কুতুকাতু (কাতুকুতু) দিতে শুরু করল। আমি কুতুকাতু একদম সইতে পারি না। আমি তখন জোরে জোরে নড়াচড়া করে হেলেদুলে উঠতেই ওরা আমার হাত ছাড়িয়ে পগার পাড়। আমি কী আর এই বয়সে ওদের মতো পাঁচিল টপকাতে পারি! বলেন সার আপনেই বলুন। এ কেমন শিক্ষা!"
    
সত্যি ব্যাপারটা কেমন হল? এর আগে হেডমাস্টার অম্বিকেশবাবু এই স্কুলেই দাপটের সঙ্গে কাজ করে গিয়েছেন, কোনোদিন একটা টুঁ শব্দ শোনা যায়নি। তিনি স্কুলটাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। বলতে গেলে উনিই এই স্কুলটাকে তিল তিল করে বড়ো করেছেন। প্রথমে তো প্রাইমারি ছিল। তারপর একটা একটা করে ক্লাশ বেড়ে বেড়ে আজ মাধ্যমিকে এসে দাঁড়িয়েছে। উনি চলে যেতেই এই বদনাম শুনতে হল? স্কুলের গা লাগোয়া বাগানটা তো তখনও ছিল। পুলকেশ অসীমবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি যান। আর কেউ যাবে না। আমি দেখছি ব্যাপারটা। অত্যন্ত প্রত্যয়ের সঙ্গে কথাগুলি তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। 
    
সেদিনই স্টাফরুমে গিয়ে সমস্ত টিচারদের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলেন। 
    
পরদিন অ্যাসেম্বলিতে প্রার্থনা হয়ে গেলে আগের দিনের অসীমবাবুর আনা অভিযোগটি  পুলকেশ তুললেন। বললেন, "কে বা কারা ওই বাগানে ঢুকেছিলে জানি না, সকলের সামনে ডেকে ওদের কিছু বলতেও চাইছি না বা শাস্তিও দিচ্ছি না। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি এমন ঘটনা ঘটে, স্কুলের কোনোরকম বদনাম হয় তাহলে কিন্তু ছাড়ব না। আমি যতটা নরম ততটাই শক্ত। একবারে স্কুলছাড়া করে দেব। উপরন্তু এমন ব্যবস্থা করব যে লেখাপড়াই চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। কোনো স্কুলে ভরতি পর্যন্ত হতে পারবে না।" 
    
ব্যস এতেই কাজ হয়েছিল। 




মন্তব্যসমূহ

এই ওয়েবজিনের জনপ্রিয় নিবন্ধঃ-

বিজ্ঞপ্তি

ছোটদের ফটোগ্রাফি শেখা - পর্ব ১ (শ্যাডো প্লে)

হাড় মজবুত করতে চাও? তাহলে রোজ শশা খাও!

ব্যাং রাজকুমারী - পর্ব ১