মঙ্গলতথ্য
লেখিকাঃ-সোমাশ্রী দত্ত
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সূর্য থেকে প্রায় ২২৭,৯৪০,০০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এবং দূরত্ব অনুসারে আমাদের সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহ হলো মঙ্গল। পৃথিবী ছাড়া সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহগুলির মতো পৌরাণিক মত অনুসারে যুদ্ধের রোমান দেবতার নামে মঙ্গলের নামকরণ করা হয়েছে। মঙ্গল গ্রহের রং বাদামী-লাল হওয়ায় মঙ্গল ‘লাল গ্রহ’ নামেও পরিচিত। এই গ্রহের পাথর ও মাটিতে প্রচুর পরিমানে আয়রন অক্সাইডের উপস্থিতির জন্য মঙ্গলের রং মর্চের মতো লাল হয়ে থাকে।
চীনা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও মঙ্গল গ্রহকে ‘অগ্নি-তারকা’ নামে অভিহিত করেছেন। বুধের পরে সৌরজগতের দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম গ্রহ মঙ্গল। মঙ্গলের আকৃতি পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক। এর ব্যাস ৬,৭৯১ কিলোমিটার। পৃথিবীর মতই মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠ শক্ত এবং পাথুরে অর্থাৎ এটি একটি "পার্থিব গ্রহ"। (নিচের ছবি দেখ)
মঙ্গল গ্রহের লালচে পাথুরে জমি ছবিঃ ফ্রিপিক |
সূর্যের থেকে অনেক দূরে অবস্থানের জন্য মঙ্গল গ্রহের তাপমাত্রা খুবই কম হয়। সূর্য থেকে মঙ্গল গ্রহে আলো পৌঁছাতে প্রায় ১৩ মিনিট সময় লাগে। বিষুবরেখার কাছে এর তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং এর তাপমাত্রা মেরুতে -১৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
সৌরজগতের গ্রহগুলির মধ্যে সব থেকে বড়ো পর্বতশ্রেণী মঙ্গলে অবস্থিত। এই গ্রহে রয়েছে অলিম্পাস মনস নামে ৬০০ কিমি ব্যাসের শিল্ড আগ্নেয়গিরি যার উচ্চতা ২১ কিমি। এটির উচ্চতা মাউন্ট এভারেস্টের প্রায় তিনগুণ। কোটি কোটি বছর আগে এই আগ্নেয়গিরির উৎপত্তি হয়। বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি এই আগ্নেয়গিরিটির লাভার অনেক প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন যা থেকে তাঁরা অনুমান করেছেন যে অলিম্পাস মনস এখনও সক্রিয় থাকতে পারে।
আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গিরিখাতও মঙ্গল গ্রহে রয়েছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে Valles Marineris। এটি ২,৫০০ মাইল লম্বা এবং ৪ মাইল গভীর। অর্থাৎ লম্বায় এটি গোটা আমেরিকার প্রস্থের সমান। (নিচের ছবি দেখ)
যে কোনো গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি হল এমন এক শক্তি যা আমাদের মাটিতে রাখতে সাহায্য করে। একজন ব্যাক্তি পৃথিবীর থেকে মঙ্গল গ্রহে প্রায় তিনগুণ বেশি জোরে লাফ দিতে পারে, কারণ এই গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনেক দুর্বল। মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণ বল পৃথিবীর অভিকর্ষের প্রায় ৩৭%।
মঙ্গল গ্রহের দুটি চাঁদ আছে। এগুলি হল ফোবোস (Phobos) এবং অন্যটি ডেইমোস (Deimos) (নিচের ছবি দেখ)। মঙ্গলের দুটি চাঁদই পৃথিবীর চাঁদের চেয়ে ছোট। অনুমান করা হয়েছে, ফোবস দূর ভবিষ্যতে মঙ্গলের সাথে সংঘর্ষ সৃষ্টি করতে পারে। এটি মঙ্গল গ্রহের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে এবং প্রায় ৫০ মিলিয়ন বছরের মধ্যে এটি সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
মঙ্গল গ্রহে ২৪ ঘন্টা ৩৭ মিনিটে একটি দিন সম্পন্ন হয়। মঙ্গল গ্রহের একটি দিন পৃথিবীর একটি দিনের চেয়ে মাত্র সামান্য একটু বেশি।
মঙ্গল গ্রহে ৬৮৭ দিনে একটি বছর সম্পূর্ণ হয়। যা পৃথিবীর একটি বছরের প্রায় দ্বিগুণ। কারণ মঙ্গল গ্রহের সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগে।
মঙ্গল গ্রহে পৃথিবীর মতই ঋতু রয়েছে, তবে তারা অনেক বেশি স্থায়ী হয়। এর কারণ হল মঙ্গল গ্রহ তার অক্ষের উপর প্রায় ২৫.১৯ ডিগ্রী হেলে আছে ও এটি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে বেশি সময় নেয়। মঙ্গল গ্রহের সূর্যের চারপাশে ডিম আকৃতির কক্ষপথ থাকায় ঋতুগুলির দৈর্ঘ্য পরিবর্তিত হয়। মঙ্গলের দীর্ঘতম ঋতু হল বসন্ত, যা ১৯৪ দিন স্থায়ী হয়। মঙ্গল গ্রহের সবচেয়ে ছোট ঋতু হল শরৎ,যা মাত্র ১৪২ দিন স্থায়ী হয়।
আটটি গ্রহের মধ্যে মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথটি সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ।
টেলিস্কোপের সাহায্য নিয়ে যে ব্যক্তি প্রথম মঙ্গল গ্রহ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তিনি হলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি। তিনি ১৬১০ সালে লাল গ্রহটি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। বারোটি মাসের মধ্যে মার্চ মাসের নামটিও মঙ্গল গ্রহর থেকে নেওয়া হয়েছে।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন যে মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠে কোনও জল নেই। আছে শুধুমাত্র শিলা, মাটির ধুলো এবং বরফ। কিন্তু ২০১৮ সালে, তারা মঙ্গল গ্রহের দক্ষিণ মেরুতে বরফের টুপির নীচে একটি হ্রদের প্রমাণ বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছিলেন। যা বিজ্ঞানীমহলে হাজারো কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে।
পৃথিবী ছাড়া মঙ্গলই একমাত্র গ্রহ যেখানে মেরু বরফের টুপি রয়েছে। উত্তরের মেরু বরফের ক্যাপটিকে প্লানাম বোরিয়াম বলা হয়, দক্ষিণের মেরু বরফের ক্যাপটিকে প্ল্যানাম অস্ট্রেল বলে।
মঙ্গল গ্রহে কোনো চৌম্বক ক্ষেত্রের উপস্থিতি নেই - যদিও এমন কিছু বিজ্ঞানী আছেন যারা বিশ্বাস করেন প্রায় ৮ বিলিয়ন বছর আগে এই গ্রহের কোথাও চৌম্বক ক্ষেত্র ছিল।
মঙ্গল গ্রহ বিশাল ধূলিঝড়ের সম্মুখীন হয়। সূর্যের চারপাশে গ্রহের উপবৃত্তাকার-ডিম্বাকৃতি কক্ষপথের ফলে প্রচণ্ড ধূলিঝড় হয় যা পুরো গ্রহকে ঢেকে রাখে এবং যা অনেক মাস ধরে চলতে পারে। মঙ্গল গ্রহে ধূলিঝড় প্রতি ঘন্টায় ১২৫ মাইল পর্যন্ত বাতাসের গতিতে পৌঁছাতে পারে। সূর্য থেকে আলো প্রায় ১৩ মিনিটের মধ্যে মঙ্গল গ্রহে পৌঁছায়।
মঙ্গলে খুব কম অক্সিজেন আছে। মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল বেশিরভাগ অংশই কার্বন ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন এবং আর্গন গ্যাস দ্বারা গঠিত।
পৃথিবী বাদে অন্যান্য গ্রহগুলির মধ্যে মঙ্গল গ্রহ প্রানের জন্য সবচেয়ে অতিথিপরায়ণ হতে পারে কিনা সেই সম্পর্কে আরও তথ্য জানবার জন্য বেশ কয়েকটি মহাকাশ অভিযানের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীমহল গবেষণা করে দেখতে চাইছেন মঙ্গল গ্রহ বসবাসের জন্য একটি কার্যকর গ্রহ হতে পারে কিনা। এইরূপ গবেষণা মঙ্গলকে সৌরজগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং আলোচিত গ্রহগুলির মধ্যে একটি করে তোলে৷
মানুষ এখনও মঙ্গল গ্রহে নিজে পৌঁছয়নি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা মঙ্গল গ্রহের গবেষণায় সাহায্য করার জন্য সেখানে মহাকাশযান পাঠিয়েছেন। মঙ্গল গ্রহে পাঠানো প্রথম মহাকাশযান ছিল ভাইকিং ল্যান্ডার্স। এই মহাকাশযানটি ১৯৭৬ সালে পৃষ্ঠে নেমে এসেছিল।
২০০৪ সালে আরও দুটি NASA রোভার, স্পিরিট এবং অপর্চুনিটি মঙ্গলে পৌঁছে গিয়েছিল।
২০১৮ সালে, NASA রোভার "কিউরিওসিটি" গ্রহের মেরু ক্যাপের নীচে তরল জলের প্রমাণ পেয়েছে ৷ এই জলটি বিশেষত একটি হ্রদ। এই জলের চিহ্ন যা প্রমাণ করে যে মঙ্গলে প্রাণ ছিল।
মঙ্গলে এখন পর্যন্ত ৪০ টি মিশন হলেও মাত্র ১৮ টি মিশন সফল হয়েছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন