ব্যাং রাজকুমারী - পর্ব ৩
(রুশ রূপকথা) ভাবানুবাদঃ- অনন্যা মণ্ডল
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
রাজপুত্র ইভান এত বিশাল ভোজের খবর পেয়েও খুশি হওয়ার বদলে মনমরা হয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলো। এবার তার একটাই চিন্তা কিভাবে সে একটি ব্যাং-কে নিজের স্ত্রী হিসেবে সকলের সামনে নিয়ে যাবে। বরাবরের মতো এবারও ঘরে ঢুকতেই দেখল লাফাতে লাফাতে ব্যাংটি তার কাছে উপস্থিত হয়েছে।
তারপর তাকে জিজ্ঞেস করল "এবার কী সমস্যা রাজপুত্র? আবারও তোমাকে এমন দুঃখী দেখাচ্ছে কেন? রাজামশাই কি আবার নতুন কিছু আজ্ঞা দিয়েছেন?"
রাজপুত্র তাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। তারপর খুব দুঃখের সঙ্গে আক্ষেপের সুরে বলল, "এখন বাবার আয়োজন করা ভোজে আমি কীভাবে তোমাকে লোকজনের সামনে নিয়ে যাই? লোকে কী বলবে?"
ব্যাং উত্তর দিল, "দুঃখ করোনা রাজপুত্র। তুমি সময় মতন ভোজে উপস্থিত হও। আমি ঠিক সময় মতন সেখানে চলে যাব। তোমাকে শুধু একটা ছোট্ট কাজ করতে হবে। যখনই তুমি হল ঘরের দরজায় টোকা দেওয়ার আওয়াজ এবং তার সাথে বিদ্যুতের গর্জন শুনবে; ভয় পেয়ো না। আর সেই সময় তোমাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে এর অর্থ কী, তুমি বোলো আমার স্ত্রী ব্যাঙের রূপে একটা ছোট্ট বাক্স চড়ে আসছে।"
যেমন কথা তেমন কাজ পরের দিন রাজপুত্র একাই ভোজের উৎসবে উপস্থিত হল। তার দাদারা তো যে যার নিজের স্ত্রীর সঙ্গে এসেছে। তার বৌদিরা সবাই সুন্দর জামা কাপড় দামী গয়নাগাটি আর স্নো পাউডারে সেজেগুজে ভোজের অনুষ্ঠান আলো করে বসে আছে।
রাজপুত্র ইভানকে দেখে তারা সবাই হাসাহাসি করে বলাবলি শুরু করল, "কী ব্যাপার! তুমি তোমার বউকে নিয়ে এলে না? তুমি না হয় একটা রুমালের মধ্যে লুকিয়ে ওকে নিয়ে আসতে পারতে। আমরা তো তাই ভাবি কোত্থেকে যে তুমি এমন সুন্দর বউ পেলে। নিশ্চয় তুমি সমস্ত জলা জঙ্গল খুঁজে ওকে নিয়ে এসেছ। তাই না? "
সেই অনুষ্ঠানে রাজা তাঁর ছেলেরা তাঁর বউমারা এবং সমস্ত অতিথিরা এক বিশাল ওক গাছে তৈরি টেবিলের চারপাশে বসে ছিল। সেই টেবিলের উপরে পাতা সুন্দর কারুকার্য করা টেবিল ক্লথ। কিন্তু যেই তারা ভোজ খাওয়া শুরু করতে যাবে, তখনই হঠাৎ করে হল ঘরের দরজায় ঠোকা দেওয়ার শব্দ আর বিদ্যুতের গর্জন শোনা গেল। সেই আওয়াজের এত জোর, যে সারা প্রাসাদ কেঁপে ওঠে। অতিথিরা ভয় যায়। কেউ কেউ তো আবার নিজের বসার জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু আমাদের রাজপুত্র ইভান এতটুকু ভয় না পেয়ে বলে, "দয়া করে কেউ ভয় পাবেন না। এটা আসলে আমার স্ত্রী, সে আসলে একটা ছোট ব্যাং। এ বোধহয় তারই আসার শব্দ।"
রাজপুত্রের কথা শেষ হওয়া মাত্র হঠাৎ ছ'টা সাদা ঘোড়াইয় টানা এক বিশাল গাড়ি রাজার প্রাসাদের সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। সেই ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে এলো রাজকন্যে ভ্যাসিলিসা। তার পরনে অপূর্ব এক নীল রঙা পোশাক। তার সেই নীল কাপড়ের উপরে মুক্তোর কাজ যেন আকাশের তারার মতন লাগছিল। মাথায় তার সুদৃশ্য মুকুট। তাকে দেখতে এত সুন্দর লাগছিল যে প্রত্যেকে তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে এসে সে রাজপুত্র ইভানের হাত ধরে তার পাশে গিয়ে বসল।
এবার আবার শুরু হলো খাওয়া-দাওয়ার পর্ব। রাজকন্যা ভাসিলিসা ছিল খুবই বুদ্ধিমতী। পানাহারের সময় সে পানপাত্র থেকে এক চুমুক নিয়ে বাকিটা নিজের পোশাকের হাতার মধ্যে ঢেলে দিলো। এমনকি হাঁসের মাংস খাওয়ার সময়ও অল্প একটু খেয়ে বাকি পড়ে থাকা হাড়গুলো পোশাকের হাতার মধ্যে লুকিয়ে ফেললো।
রাজার বাকি দুই ছেলের বউ দেখাদেখি তাকেই নকল করে বসল। তারা তো জানতো না পরে কি হতে চলেছে।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হলে যখন সবাই নিজের আনন্দে নিজের মতন করে নাচ গান করছিল তখন বুদ্ধিমতি ভ্যাসেলিসা, প্রিন্স ইভান এর হাত ধরে একসাথে নাচ করতে শুরু করল। সে এত অবিশ্বাস্য রকমের ভালো নাচ করলো যে সমস্ত অতিথিরা তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। নাচ শেষে তার পোশাকের বাঁ-হাতা নাড়াতেই সেখান থেকে তৈরি হল এক অদ্ভুত সুন্দর নদী। যেইমাত্র সে তার জামার ডান-হাতা নাড়ালো পোশাকের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল সুন্দর সাদা ধবধবে একটা রাজহাঁস এবং সে সেই নদীর জলে সে ভেসে বেড়াতে লাগল। এই সব কান্ডকারখানা দেখে রাজা এবং তার অতিথিরা তো সকলে বিস্ময় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যায়।
েবার পালা দুই ভাইয়ের স্ত্রীদের, তারাও অনুষ্ঠানে নাচতে শুরু করে। কিন্তু নাচতে নাচতে যেইমাত্র তারা নিজেদের জামার হাতা নাড়াতে যায় অমনি তাদের পোশাকের ভিতর থেকে মাংসের হাড়ের টুকরো আর পানীয় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। একটা হাড়ের টুকরো তো গিয়ে পড়ল একদম রাজার চোখের উপর। রাজা এমন রেগে গেলেন যে সেই দুই বউকে তিনি তৎক্ষণাৎ প্রাসাদ থেকে বের করে দিলেন।
ইতিমধ্যে রাজপুত্র ইভানের তার বউ-এর উপর সন্দেহ শুরু হয়। সে তাড়াতাড়ি সেই বিশাল হল ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে সোজা নিজের ঘরে চলে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে বারান্দায় একটা ব্যাঙের খোলস পড়ে আছে।
সেটা দেখামাত্র রাজপুত্র ইভান সেটা উনুনে পুড়িয়ে ফেলল। এই সবকিছু হয়ে যাওয়ার পর যখন রাজকন্যা ভাসিলিসা ফিরে এলো, তখন দেখল যে তার ব্যাঙের খোলস গায়েব। খুবই নিরাশ হয়ে সে তখন তার স্বামীকে বলল, "এ কি করলে তুমি রাজপুত্র ইভান! তুমি যদি আর মাত্র তিনটে দিন অপেক্ষা করতে তাহলে আমি সারা জীবনের মতন তোমার সাথেই থাকতে পারতাম। কিন্তু এবার তো আমাকে বিদায় জানিয়ে চলে যেতে হবে। তুমি যদি আমাকে খুঁজতে চাও তাহলে তিনগুণ নয় সাতাশটি দেশ পেরিয়ে ত্রিশতম রাজ্যে যেও। সেখানে অমর কাশাচির কাছে গেলে হয়তো আমার খোঁজ পাবে।"
এই কথাগুলি বলে শেষ হতে না হতেই রাজকন্যে ভ্যাসেলিসা একটা ধূসর পাখির রূপ নিয়ে জানলা দিয়ে উড়ে চলে যায়। স্ত্রীকে হারিয়ে অনুতাপে দুঃখে রাজপুত্র কেঁদে ফেললে। পৃথিবীর কোন প্রান্তে গেলে যে সে আবার তার স্ত্রীকে খুঁজে পাবে তা সে নিজেও জানে না। তাই অনেক কান্নাকাটির পরে ঠিক করে তার স্ত্রী রাজকন্যা ভাসিলিসার খোঁজে সে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তরেই হোক, যাবে ও তাকে ফিরিয়ে আনবে তার জীবনে।
ছবির সূত্রঃ ফ্রিপিক
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন