ব্যাং রাজকুমারী - পর্ব ৪

 

(রুশ রূপকথা) ভাবানুবাদঃ- অনন্যা মণ্ডল

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------



দেশে-দেশে রাজপুত্র ইভান তার একমাত্র স্ত্রীকে খুঁজে বেড়াতে লাগল। সে রাস্তায়-রাস্তায় এত ঘুরলে যে তার চটি গেল ছিঁড়ে। জামাকাপড় হয়ে গেল মলিন। বৃষ্টিতে তার টুপি ভিজে ছুপচুপে হয়ে গেল। এমন দুর্দশায় একদিন হঠাৎ করে দেখা হল এক বৃদ্ধ মানুষের সঙ্গে। 

সেই বৃদ্ধ তাকে জিজ্ঞাসা করলে "বাছা, তুমি কি কিছু খুঁজছো?"
 
রাজপুত্র উত্তর দিল সে তার একমাত্র স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলেছে এবং তাকেই সে খুঁজতে বেরিয়েছে।

তাই শুনে বিস্তর দুঃখ প্রকাশ করে সেই বৃদ্ধ বলেন, "হায় হায় রাজপুত্র, তুমি করেছ কী? কী ভেবে তুমি তার ব্যাঙের খোলস কে পুড়িয়ে ফেললে? তোমার এটা করা একদম উচিত হয়নি। আসলে ব্যাপারটা হল ভ্যাসিলিসা অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এবং জ্ঞানী। ছোটবেলা থেকেই সে তার বাবার চেয়েও বেশি বুদ্ধি রাখত। তাই একদিন তার বাবা রেগে গিয়ে তাকে তিন বছরের জন্য ব্যাং হয়ে যাওয়ার অভিশাপ দেন।" 

এরপর সেই বৃদ্ধ তার জামার পকেট থেকে একটা মন্ত্রপূত বল বের করে রাজপুত্রের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন, "যাক গে! যা হয়ে গেছে তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। তুমি বরং এই বলটা নাও। এই বলটা যেদিকে গড়িয়ে গড়িয়ে যাবে তুমিও তার পিছু নাও। তুমি তোমার লক্ষ্যে নিশ্চয় পৌঁছবে।"

রাজপুত্র তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলটির পিছু নিতে শুরু করে। বলটা যত গড়াতে থাকে সেও তার পিছু পিছু হাঁটতে থাকে।

একটা খোলা মাঠের উপর দিয়ে বলটা যখন গড়াচ্ছে তখন এক ভল্লুকের সঙ্গে ইভানের দেখা হয়। প্রথমে প্রাণরক্ষার তাগিদে ভল্লুকটাকে মেরে ফেলতে যায়। কিন্তু কী আশ্চর্য ভল্লুকটা হঠাৎ মানুষের গলায় বলে ওঠে, "দয়া করে আমাকে মেরো না রাজপুত্র। আমি তোমার কাজে আসব।" ভল্লুকের কথা শুনে রাজপুত্রের দয়া হলো। তাকে ছেড়ে দিয়ে আবার বলের পিছু নেল সে। 

এবার পথে দেখলে একটা হাঁস উড়ে যাচ্ছে। তার দিকে তীর ছুড়তে গিয়ে সে চমকে উঠলো। এই হাঁসটিও মানুষের গলায় বলে উঠলো "আমাকে মেরো না রাজপুত্র আমিও তোমার কাজে আসবো।" রাজপুত্রের তার প্রতিও দয়া হলো। 

আরও কিছুক্ষণ পরে দেখা হল একটা খরগোশের সঙ্গে। এই খরগোশের দিকেও তীর ছুঁড়তে গিয়ে থেমে গেল রাজপুত্র কারণ খরগোশটিও মানুষের গলায় বলে উঠলো "আমাকে মেরো না। আমি একদিন তোমার কাজে আসবো"। ঠিক আগের দুইবারের মতো এবারও রাজপুত্র খরগোশটিতে যেতে দিল। 
 
এবার হাঁটতে হাঁটতে রাজপুত্র একটা নীল সাগরের ধারে এসে পৌঁছল। সেখানে সমুদ্রের তীরে একটি মাছ পড়ে রয়েছে। তার অবস্থা বড়ই করুণ। সে একটুও শ্বাস নিতে পারছে না। এমন সময় মাছটা বলে উঠলো, "রাজপুত্র ইভান আমাকে একটু দয়া করুন। আমাকে আবার সমুদ্রের জলে ছেড়ে দিন। আমাকে বাঁচান। আমি পরবর্তীতে আপনার উপকারে লাগবো"। সেই কথা শুনে রাজপুত্র তাকে সমুদ্রের জলে ছেড়ে দিয়ে এসে আবার বলের পিছনে হাঁটতে শুরু করল।

শেষমেষ সেই বলটা গিয়ে থামলো একটা বনের ভিতরে। বনের মধ্যে প্রবেশ করার পর রাজপুত্র একটা ছোট্ট কুটির দেখতে পেল। কিন্তু কী আশ্চর্য! সেই কুটির দাঁড়িয়ে আছে একটা মুরগির পায়ের উপর। কুটিরটা এমন ভাবে বনবন করে ঘুরছে ঠিক যেন মনে হচ্ছে এটা একটা জীবন্ত প্রাণী। অবাক হয়ে রাজপুত্র তার সামনে গিয়ে সাহায্য চাইলো। বলল "এ আমি কী দেখছি! ছোট কুটির, আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই। দয়া করে তোমার আসল রূপে ফিরে এসো।" 

রাজপুত্রের কথা শুনে কুটিরটি জঙ্গলের দিকে পিঠ রেখে রাজপুত্রের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো। সেই ছোট্ট কুটির নিজের আকারে ফিরে আসতেই রাজপুত্রের প্রবেশ করলো তার মধ্যে। কুটিরের মধ্যে ঢুকতেই দেখলো সেখানে শুয়ে আছে আশ্চর্য জাদুকর বাবা ইয়াগা। তার চিবুক উনুনের উপর রাখা আর তার নাক দেওয়ালে গিয়ে ঠেকেছে। 

রাজপুত্রকে দেখে সে জিজ্ঞাসা করল "কী ব্যাপার তুমি আমার খোঁজ করছ কেন? তুমি কি তোমার ভাগ্যের খোঁজ করছ নাকি তুমি তোমার ভাগ্য থেকে পালানোর চেষ্টা করছো ?"

রাজপুত্র খুবই শ্রান্ত গলায় বললে, "আমি বড়ই ক্ষুধার্ত। কোন প্রশ্ন করার আগে দয়া করে আগে আমাকে কিছু খাবার এবং পানীয় দিন। আরেকটু স্নান করার জল।"
 
বাবা ইয়াগা তাকে স্নান করার জন্য গরম জল দিলেন। পেট ভরানোর জন্য খাবার আর পানীয় দিলেন। শোয়ার জন্য বিছানা দিলেন। একটু সুস্থ হয়ে রাজপুত্র বললে সে তার স্ত্রীকে খুঁজতে এসেছে। তার স্ত্রী বুদ্ধিমতী রাজকন্যা ভাসিলিসা। 

বুড়ো জাদুকর বললে "আমি জানি তোমার স্ত্রী এখন অমর কাসাচির কাছে আছে। অমর কাসাচিকে না বধ করে তার কাছ থেকে তোমার স্ত্রীকে উদ্ধার করে আনা খুব কঠিন। কারণ অমর কাসাচির মৃত্যু লেখা আছে একটা ছোট্ট সূঁচের ডগায়। সেই সূঁচ আছে একটা ডিমের মধ্যে, যেটা আবার আছে এটা হাঁসের পেটের মধ্যে। হাঁসটা আছে একটা খরগোশের শরীরের মধ্যে আর খরগোশটা এখন আছে একটা পাহাড়ের টিলার মধ্যে।  সেই পাহাড়ের টিলা যে সে জায়গায় নয়। এক বিশাল ওক গাছের মাথায় সেই পাহাড়ের টিলা। আর সেই ও গাছকে সারাক্ষণ পাহারা দেয় দুষ্টু কাশাচি।"
 
রাজপুত্র ইভান সারাটা রাত বুড়ো জাদুকরের কুটিরে কাটাল। পরের দিন সকালে সেই জাদুকর জানালো কিভাবে সে বিশাল ওক গাছের কাছে পৌঁছতে পারবে। রাজপুত্র তার কথামত সেই গন্তব্যে পৌঁছিয়ে ওক গাছের দেখা পেল। তার পাতাগুলো হাওয়ায় দুলছে। বাতাসে শন শন করে আওয়াজ হচ্ছে। তার মাথার উপর একটা পাথরের টিলা। সেই টিলা এত উঁচুতে যা কোনোভাবেই কোন মানুষের নাগালে আসা সম্ভব নয়। 

রাজপুত্র গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ভাবতে শুরু করল কী উপায় করা যায়। এমন সময় পথে দেখা গেল সেই ভল্লুকটি তার সামনে এসে উপস্থিত হয়। রাজপুত্রকে অভয় দিয়ে সে নিজেই ছুটে গিয়ে ওক গাছটাকে প্রচন্ড জড়ে একটা গুঁতো মারে। আর কী কান্ড! অমনি সেটা শিকড় সমেত উপড়ে পড়ে যায় মাটিতে। পাথরের টিলাটাও মাটিতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। টিলার ভিতর লুকিয়ে থাকা খরগোশ ছুটে বেরিয়ে আসে। আর এক মুহূর্তের মধ্যে অন্য আরেকটা খরগোশ তার পিছু নেয় এবং প্রথম খরগোশটাকে ধরে তার শরীর চিরে খন্ড খন্ড করে ফেলে। 

মৃত খরগোশের শরীর থেকে বেড়িয়ে আসে একটা হাঁস। যেই না সেই হাঁস ডানা মেলে আকাশে উড়তে শুরু করে, অমনি আরেকটা হাঁস তার পিছু নিয়ে তাকে ধরে ফেলে, আর প্রথম হাঁসটাকে মারে জোর এক ধাক্কা। ধাক্কার ফলে তার শরীর থেকে বেরিয়ে  আসে একটা ডিম। ডিমটা গিয়ে পড়ে নীল সাগরের জলে। এই সমস্ত কিছু ঘটতে দেখার পর দুঃখে রাজপুত্রের চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে য়াসে। 

যাহ! এত কাণ্ড করে শেষ পর্যন্ত ডিমটা কিনা গিয়ে পড়ল সমুদ্রে! 

কিন্তু তখনই ঘটল সেই আশ্চর্য ঘটনা। রাজপুত্রের হাতে বেঁচে যাওয়া সেই মাছটা কোথা থেকে জানি এসে উপস্থিত হয়ে ডিমটাকে জলে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচায়। এরপর সেটিকে মুখে করে সাঁতরে তীরের কাছে নিয়ে আসে। তাই দেখে রাজপুত্র ইভানের আনন্দ আর ধরে না। 

মাছের কাছ থেকে ডিমটা নিয়ে সেটাকে এবার সে ভেঙে ফেলে। বের করে আনে সূঁচ। ভেঙে ফেলে সূঁচের ডগা। আর সঙ্গে সঙ্গে কাশাচি ছটফট করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। 

এইবার রাজপুত্র কোনরকম বাধা ছাড়াই কাসাচির সেই সাদা পাথরের প্রাসাদে প্রবেশ করে তার স্ত্রীকে উদ্ধার করবে বলে। রাজপুত্রকে দেখা মাত্র রাজকন্যার ভ্যাসিলিসা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। দুজন দুজনকে দেখে যারপরনাই খুশি। তারপর রাজপুত্র ইভান এবং রাজকন্যা ভাসিলিসা নিরাপদে তাদের নিজের প্রাসাদে ফিরে আসে এবং আজীবন সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকে।

~ শেষ

ছবির সূত্রঃ ফ্রিপিক


মন্তব্যসমূহ

এই ওয়েবজিনের জনপ্রিয় নিবন্ধঃ-

বিজ্ঞপ্তি

ছোটদের ফটোগ্রাফি শেখা - পর্ব ১ (শ্যাডো প্লে)

হাড় মজবুত করতে চাও? তাহলে রোজ শশা খাও!

ব্যাং রাজকুমারী - পর্ব ১