The Elephant Whisperers - এই অস্কার পাওয়া সিনেমাটি কেন ছোটদের দেখা উচিৎ
লেখিকাঃ- অনন্যা মণ্ডল
প্রকৃতি দিগন্ত বিস্তৃত। সমস্ত পশু পাখি জীব জন্তু এবং মানুষের কাছে প্রকৃতি নিজেকে উদারভাবে উন্মুক্ত করে রেখেছে। অথচ সময়ের নিরিখে মানুষ উন্নয়নের লোভে প্রকৃতিকে কলকারখানা এবং বিল্ডিং এর জঙ্গলে পরিণত করেছে। এর ফলে বনের পশুপাখিরা তাদের ঘর হারিয়েছে। তবু এখনো কিন্তু কিছু অঞ্চলে এমন কিছু মানুষ আছে যারা প্রকৃতিকেই নিজের ঘরবাড়ি, আশ্রয় বলে মনে করে।
তোমরা কি জানো সেই সব মানুষ এখনো বন জঙ্গলের মধ্যে থেকেই জীবনযাপন করে এবং তারা প্রকৃতি থেকে ঠিক ততটাই নেয় যতটুকু তাদের প্রয়োজন? তাদের কাছে কিন্তু প্রকৃতি মন্দিরের মতোই পবিত্র। আর প্রকৃতির সমস্ত পশু পাখিই তাদের আপন পরিবার। সদ্য অস্কার পাওয়া বেস্ট ডকুমেন্টারি সর্ট ফিল্ম দ্য এলিফ্যান্ট হুইস্পারার (The Elephant Whisperer) কিন্তু এমনই এক সত্যি ঘটনার কথা তুলে ধরেছে যেখানে হাতি এবং মানুষের ভালোবাসা ঘিরে তৈরি হয়েছে একটা মিষ্টি গল্প। সার্কাসে বা চিড়িয়াখানায় নিশ্চয় তোমরা কখনো না কখনো ইয়া বড় হাতি দেখেছো, কিন্তু হাতিকে নিয়ে সিনেমা তোমরা কে কে দেখেছো? কার্তিকি গনসাভেল এর পরিচালনা করা এই সিনেমার গল্পটা শুনে দ্যাখো তো সিনেমা টা চটজলদি দেখে ফেলতে ইচ্ছে করছে কি না?
গল্প শুরু হয় দক্ষিণ ভারতের এক অঞ্চল মুদুমালাই এর থেপক্কুরু থেকে। সেখানে কাত্তুনায়াকাম উপজাতির বসবাস। তাদের কাজ হল পথ হারা অনাথ হাতি দের দেখা শুনা করা। তাদের মধ্যে একজন হল বোমান। সে কিন্তু একই সঙ্গে হাতির মাহুত এবং পূজারীও বটে। হাতি দেখাশোনা করার রীতি তাদের বংশ পরম্পরায় চলে আসছে। আর একজন হলো বিলি। এদের দুজনেরই কাজ হল আহত হারিয়ে যাওয়া হাতির দেখাশোনা করা। একদিন বনদপ্তর থেকে এদের কাছে খবর আসে রঘু নামের একটি হাতির দেখাশোনা তাদের করতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত সেই বাচ্চা হাতিটির মা মারা গেছে কারেন্ট এর তারে আহত হয়ে এবং এই বাচ্চা হাতিটির লেজটিও কুকুরে কামড়ে দেওয়ায় সেখানে ঘা হয়ে পোকা হয়ে গেছে সবমিলিয়ে রঘুর অবস্থা শোচনীয়। জঙ্গলে খাবারের ভাটা পড়লে মা হারা ছোট্ট রঘু খাবারের লড়াইয়ে পেড়ে উঠলো না। কিন্তু তারপরে হলো আরো বড় বিপত্তি কারণ সে তার দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। বনদপ্তর থেকে তাকে দলের সাথে মিলিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করা হলেও বিশেষ লাভ হয়নি। কারণ পশু পাখিদের তো গায়ের গন্ধ শুঁকেই বাচ্চাদের শনাক্ত করে নেয় তাদের মায়েরা। তাই শেষ পর্যন্ত বনদপ্তর থেকে বোমান এবং বিলিকে রঘুর দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুজনে মিলে ভালোবাসা এবং যত্নে রঘুকে ধীরে ধীরে সারিয়ে তুলতে থাকে। এভাবে ধীরে ধীরে তিনটে বছর কেটে যায় আর বাচ্চা রঘুও এখন অনেকটা বড় হয়ে গেছে। এতদিনে বোমান আর বিলির পরিবারের সদস্য হয়ে উঠেছে রঘু। বোমান তার গলায় একটা ঘন্টা বেঁধে রেখেছে যাতে করে জঙ্গলের মধ্যে গেলেও রঘুকে খুঁজে পেতে সমস্যা না হয়। রঘুকে ওরা নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসে আর রঘুও কিন্তু দস্যিপনায় কম যায় না। স্নান করানোর সময় বারণ করা সত্ত্বেও সাবানের ফেনা খেয়ে ফেলে, আগুনের পাশে বসে বিলির আদর খায়, বন্ধু কৃষ্ণ-র সাথে ঘাস খেতে চলে যায় দূরে দূরে।
এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। একের পর এক ঋতু বদলাচ্ছিল রঘু-কে ঘিরে বোমান আর বিলি ও নিজেদের সব দুঃখ কষ্ট ভুলে আনন্দে জীবন কাটাচ্ছিল। বিলি যখন মেয়েকে হারিয়ে কাঁদে রঘু শুঁড় দিয়ে তার চোখের জল মুছে দেয়। তেমনই বোমান আর বিলিও রঘুর পছন্দমত খাবারদাবার তাকে আদর করে খাওয়ায়। কখনো আটা, নারকোল কখনো বা গুড়ের লাড্ডু, কখনো বা স্ট্র দিয়ে দুধ খায় রঘু। আসলে তারা মনে করে হাতিরা যেন দেবতার আশীর্বাদ। তারা মনে করে হাতির সেবা করা মানেই ভগবানের সেবা করা। হাতির দেখাশুনা করাই তাদের পেশা তাদের ধ্যান জ্ঞান। হাতিদের দেখা শোনা করলে তবেই তাদের ঘরে অন্নের যোগান হবে। তাই বছরের কিছু কিছু সময় তারা হাতিকে মালা পরিয়ে ভগবান গণেশের কাছ থেকে আশীর্বাদ নেয়।
যখন বছর গড়িয়ে আবার গ্রীষ্মকাল এলো সেই সময় বনদপ্তর থেকে আরো একটি বাচ্চা হাতি কে দেখাশোনা করার জন্য বোমান এবং বিলির কাছে পাঠানো হয়। এই ছোট্ট হাতি টির নাম আম্মু। এখন রঘুর সাথে সাথে বোমান এবং বিলি আম্মুর ও খেয়াল রাখে। প্রথম প্রথম রঘুর একটু হিংসে হয় কারণ সে দেখে তার বাবা-মায়ের আদর যেন ভাগ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পরে আম্মুর সাথে রঘুর ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সময়ের সাথে সাথে দুজনের মধ্যে ভাব হয়ে যায় এবং এখন তারা সব সময় একসাথে থাকে এবং খেলা করে।
আম্মু এবং রঘুর মধ্যে যেমন বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল তেমনি একসাথে অনেক দিন ধরে থাকতে থাকতে এবং হাতিতে দেখাশোনা করতে করতে বোমান এবং বিলির মধ্যেও একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়। তাদের বিয়ের দিনে নিজেদের সাথে সাথে আম্মু এবং রঘুকেও তারা নতুন জামা কাপড়ে সাজিয়ে তোলে। চারজনের খুশির পরিবারে মাঝে মাঝেই আসে সঞ্জনা। সে বিলির নাতনি। সেও আবার হাতিদের খুব ভালোবাসে এবং মাঝে মাঝেই সে দিদানকে হাতিদের দেখাশোনা করায় সাহায্য করে। বোমান আর বিলি খুব যত্ন করেই হাতিদের পালন করতে থাকে। স্নেহের সঙ্গে তাদের সঠিক সময় খেতে দেওয়া, স্নান করানো এবং তাদের ঘর পরিষ্কার রাখা ইত্যাদি সমস্ত কিছু নিয়ম মেনে করতে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বনদপ্তর থেকে একদিন নোটিস আসে যে রঘুকে দেখাশোনা করা দায়িত্ব অন্য এক কেয়ারটেকারকে দেওয়া হবে। সে আর এখন থেকে বোমান এবং বিলির কাছে থাকবে না কারণ সে এখন অনেক বড় আর আগের থেকে একেবারে সুস্থ সবল হয়ে উঠেছে। তারা কেউই এই সিদ্ধান্তে খুশি ছিল না। কিন্তু বনদপ্তরকে অনেকবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও কোন লাভ হল না। রঘুকে ছেড়ে যেতেই হলো। রঘুও কিন্তু ফিরে যাওয়ার সময় বারবার পিছন ফিরে তাকাচ্ছিল। সেই সময় রঘুর চোখ আর বিলির মুখের অসহায়তা দেখে যেন মনে হয় একটা ছোট্ট সন্তানকে তার মা-বাবার থেকে আলাদা করে দেওয়া হচ্ছে। রঘু চলে যাওয়ার পর সবার মনই খুব খারাপ হয়ে যায়। শুধু বোমান বা বিলি নয় আম্মুও কষ্টে কয়েকদিন কিছুই খায় না।
ধীরে ধীরে সেই শোক সামলে উঠলে বিলি ঠিক করে যে এভাবেই যত্নে আদরে কিভাবে হাতিদের দেখাশোনা করা যায় সেই শিক্ষায় পরের প্রজন্মকে দেবে। যেন ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা ছেলেবেলা থেকেই হাতিদের ভালোবেসে তাদের দায়িত্ব নিতে শেখে। বিলি আজ তার গ্রামে হাতিদের মা বলে পরিচিত। এখনো মাঝে মাঝে রঘুর সাথে দেখা হয়। রঘুকে দেখতে পেলেই বোমান ছুটে যায়। দুজন দুজনকে আনন্দে জড়িয়ে ধরে। রঘু এবং আম্মু দুজনেই সুস্থ এবং সুন্দরভাবে বড় হতে থাকে আর বোমান এবং বিলি আমাদেরকে কি শেখায় জানো? রোমান এবং বিলির এই ভালোবাসা আমাদেরকে শেখায় যে, পশু হোক বা মানুষ সত্যিকারের ভালোবাসা পেলে সবার জীবন কত সুন্দর আর সহজ হয়ে যায়। পশুরাও পোষ মানে ভালোবাসার কাছে। সেই ভালোবাসা ফিরিয়ে দেয় সময়মতো।
বেশিরভাগ সিনেমাতেই হয়তো বন্য পশু এবং প্রকৃতি কে নানা রকম ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখতে পাবে কিন্তু এলিফ্যান্ট হুইস্পরার নামের এই মিষ্টি ডকুমেন্টরি সিনেমাটিতে কিন্তু তোমরা দেখতে পাবে মানুষের সঙ্গে কোনো পশুর সম্পর্ক ঠিক কতটা গভীর আর নিঃস্বার্থ। তাই তোমরাও এভাবেই ভালোবেসো তোমার আসে পাশের সমস্ত পশু পাখি গাছ পালা কে। মনে রেখো তারাও তোমারই মতন এই পৃথিবীর বাসিন্দা আর তাদের সঙ্গে মিলে মিশে থাকলে তবেই আমরা ভালো থাকবো।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন