লঙ্কাকাণ্ড

 লেখিকাঃ- সায়ন্তনী ব্যানার্জী

------------------------------------------------------------------------------------------------------------



“ক্কা! ক্কা! ক্ষাহ!”

“ক্কা! ক্কা! ক্ষাহ!”

ধ্যাত্তারি! সাত সকালে এই রকম বিদ্ঘুটে আওয়াজ শুনে ঝুমকির কাঁচা ঘুম গেল ভেঙ্গে। আজ রবিবার, ছুটির দিন। একটু বেশী বেলা অবধি ঘুমিয়ে আয়েশ করবে ঠিক করেছিল সে। গেল সব ভেস্তে!

চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে বসল ঝুমকি। বেশ বিরক্ত হয়েছে সে। সবে একটু আড়মোড়া ভেঙ্গে পাশ ফিরে শুয়ে আবার ঢুলবার তাগিদ করছিল। কাঁচা ঘুমটা দিয়েছে কে চটকিয়ে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল কোথা থেকে আসছিল এই অদ্ভুত শব্দ। আর তখনই আবার শুনতে পেল সে, “ক্কা! ক্কা! ক্ষাহ! ক্কা! ক্কা! ক্ষাহ!”

শব্দটা আসছিল বারান্দার দিক থেকে। বিছানা থেকে নেমে পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় সে। বারিন্দার দরজার সামনে পর্দা ঝুলছে। পর্দার ওপার থেকে আসছিল শব্দটা। আস্তে করে পর্দা সরিয়ে উঁকি মারল ঝুমকি। যা দেখল তাতে বেশ অবাকই হলো সে। 

ঝুমকির মা পরম স্নেহে এক বাটি মুড়ি নিয়ে ‘শ্রীমান কাক্কেশ্বর কুচকুচে’-কে মানে একটা ধেড়ে কাক-কে খাওয়াচ্ছেন। কাকটা মুড়ির বাটিতে ঠোঁট ডুবিয়ে খপ খপ করে মুড়ি তুলে খেতে খেতে মাঝে মাঝেই এমন বিদ্ঘুটে শব্দ করে ডাকছে।

“মা, এটা তুমি কী করছ?” – বেশ তেড়ে গিয়ে ঝুমকি তার মা-কে জিজ্ঞেস করে।

“দেখছিস তো খাওয়াচ্ছি”, - তার মা বলে। 

শুনে ঝুমকি বেশ রেগে গিয়ে বলে, “সে তো বুঝলাম, কিন্তু এই পাজিটাকে সাত সকালে ডেকে এনে না খাওয়ালেই চলছিল না? বিশ্রি ক্যা ক্যা করে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিল ব্যাটা!” 

“বেশ হয়েছে! আরো পড়ে পড়ে ঘুমোও বেলা অবধি”, - এই বলে মুচকি হেসে তার মা মুড়ির বাটি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। শ্রীমান কাক্কেশ্বর কুচকুচেও ঝুমকির দিকে তাকিয়ে একটা বিকট “ক্কা!” বলে উড়ে পালালো।

“যাচ্ছেতাই!” – ঝুমকি ভেবে পেল না তার ঘুমোনোর উপর এইরকম প্রতিশোধ নেওয়ার কী কারণ থাকতে পারে কাকটার।


এই ধেড়ে কাকটিকে খাওয়ানোর গল্প কিন্তু আজকের নয়। ঝুমকির মা খুব পশুপাখি ভালোবাসেন। বারান্দায় পাখি এসে বসলেই বিস্কুট, মুড়ি, কেকের টুকরো, এটা ওটা দিয়ে খাওয়ান। এইভাবেই খাওয়াতে খাওয়াতে একটা কাকের বাচ্চা তাঁর খুব ন্যাওটা হয়ে ওঠে। 

কয়েক মাস আগে এক ঝড়ের রাতে বাড়ির সামনের আম গাছের উপর থাকা কাকের একটা বাসা উলটে যায়। একটা কাকের ছানা কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে যায়। ঝুমকিদের বারান্দার রেলিঙে জবুথবু হয়ে বসে ছিল ভেজা কাকের ছানাটা। ভালো করে উড়তেও শেখেনি সে। ঝুমকির মায়ের দয়ার শরীর। শ্রীমান কাক্কেশ্বর কুচকুচের জন্য বরাদ্দ হল এলাহি ব্যাপার। সকালে বিস্কুট, মুড়ি সহযোগে ব্রেকফাস্ট। দুপুরে ডাল, ভাত, মাছের কাঁটা বা মাংসের হাড়। বিকেলে ঘুমোতে যাবার আগে আরেকপ্রস্ত নাস্তা। এইভাবেই চলছিল কাকের সেবা যত্ন। শ্রীমান কাক্কেশ্বর কুচকুচে নামটা অবশ্য ঝুমকিরই দেওয়া। 

কিছুদিন পর ঝুমকি লক্ষ্য করল শ্রীমান কাক্কেশ্বর কিন্তু কোথাও উড়ে যায় না। বাড়ির সামনের ওই আমগাছের ডালেই ডেরা বেঁধেছে সে। ঝুমকির মায়ের কাছে খেয়ে উড়ে গিয়ে ওই গাছের ডালেই বসে বসে সারাদিন কাটায়। অন্য সময়ে খাবার খুঁজতে সে যায় না। বোঝাই যায় কাকটা ভীষণ ভাবে ঝুমকিদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে খাবারের জন্য। ব্যাপারটা ঝুমকির মোটেও ভালো ঠেকেনি। 

তো রবিবারের বাকি দিনটা বেশ নির্ঝঞ্ঝাটেই কেটে গেল। কিন্তু গোল বাঁধলো পরের দিন থেকে। ঝুমকির কলেজ দুপুরে, তাই সকালবেলায় একটু দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাস তার। কিন্তু শ্রীমান কাক্কেশ্বরের হেঁড়ে গলায় ‘ক্কা ক্কা’ স্বরের এ্যালার্ম ক্লক তাকে ভোরবেলাতেই ঘুম থেকে তুলে দিতে লাগলো। 

এই কারণে শ্রীমান কাক্কেশ্বরের উপর ঝুমকির রাগটা তো ছিলই, সেটা আরো সপ্তমে চড়ল সেদিন কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে জলখাবার খেয়ে নিজের ঘরের টেবিলে পড়তে বসতে গিয়ে তার চোখ কপালে উঠলো। 

এ্যামা! একী! সারা টেবিল জুড়ে সাদা সাদা এটা কী? বুঝতে বাকি রইলো না আর। শ্রীমান কাক্কেশ্বর ঝুমকির টেবিলটিকে টয়লেট বানিয়ে ছেড়েছে! উফ!

“মা! তাড়াতাড়ি এসো, দেখে যাও তোমার আদরের পুষ্যি কী করেছে আমার টেবিলে”।

ঝুমকির হাঁকডাকে তার মা ছুটে এলেন। টেবিলের উপর সাদা সাদা ছোপ দেখিয়ে ঝুমকি তখন কটমট করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

“ওহ! বোধহয় বিকেলবেলা জানালাটা বন্ধ করতে ভু্লে গেছিলাম। কাকটা ঢুকে পড়েছিল। কী আর করবি, একটু পরিষ্কার করে নে” – এই বলে ঝুমকির মা তাকে সান্ত্বনা দিলেন।

“মানে! এখন জল ঘেঁটে এইসব সাফাই করব আমি?” – ঝুমকি গজরাতে থাকে।

তার মা বেগতিক দেখে শেষে নিজেই পরিষ্কার করে দিলেন টেবিলটা।


ব্যাপারটা এখানেই থেমে গেলে ঠিক হতো। কিন্তু না, শ্রীমান কাক্কেশ্বর কুচকুচের সেরকম কোনো ইচ্ছাই যেন ছিল না। ঝুমকিকে জ্বালাতন করার নানান ফন্দি ফিকির বের করতে লাগল কাকটা।

কখনও এ্যালার্ম ক্লকের ভূমিকায় বিদ্ঘুটে “ক্কা ক্কা ক্ষা” ডাকে সকালে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেওয়া তো কখনও বারান্দার গ্রিলে বসে সারা দুপুর ধরে হাঁকডাক করে বিরক্ত করা। বারান্দার ফুল গাছের টবে মাছের কাঁটা,মাংসের হাড় গুঁজে রাখা, আবার কোনো কোনো দিন বারান্দার রেলিং-এ টয়লেট করা, কিছুই বাদ রাখছিল না। 

তো সেদিন আরেক রবিবারে ঝুমকি বেশ সকাল সকাল উঠে পড়েছে। উঠবে নাই বা কেন, সেদিন তার মা স্পেশাল ব্রেকফাস্ট বানিয়েছেন যে – আলুর পরোটা! এক প্লেট গরম গরম আলুর পরোটা, মুচমুচে লঙ্কাভাজা আর আচার নিয়ে সবে বারান্দার পাশের সোফাটায় আরাম করে বসেছে ঝুমকি, ওমনি শুনতে পেল শ্রীমান কাক্কেশ্বর কুচকুচের গলা। বেশ নরম গলায় একটা “ক্ষা” শব্দ।

শ্রীমান কাক্কেশ্বর বারান্দার রেলিং-এ বসে ঘাড় কাত করে চোখ টেরিয়ে ঝুমকির হাতে ধরা আলুর পরোটার প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে ওই খাবারটা ওনার চাই।

ঝুমকি পাত্তা দিল না। আহা! কতদিন পরে মা আলুর পরোটা করেছে। রসিয়ে রসিয়ে আচার দিয়ে খেতে লাগল সে। আর আড় চোখে লক্ষ্য করল শ্রীমান কাক্কেশ্বর একভাবে ঘাড় কাত করে চোখ টেরিয়ে দেখে যাচ্ছে তাকে।

“ক্ষা,ক্ষা” – নরম থেকে একটু গরম স্বরে ডেকে উঠল কাক্কেশ্বর। ঝুমকির ঠোঁটে হাসি জেগে উঠল।

“ব্যাটাকে খেতে দিইনি বলে বড্ড রাগ হয়েছে। উহ, নোলা কত” -  মনে মনে ভাবে ঝুমকি।

ঝুমকি এদিকে পরোটা খাচ্ছে আর ওদিকে কাক্কেশ্বরের গলাও চড়ছে।

“ক্কা, ক্কা। ক্ষা, ক্ষা। ক্ষাও ক্ষাও” – কতরকম স্বরে কাকুতিমিনতি করে চলেছে কাকটা। সেই সঙ্গে একটু একটু করে লাফ দিয়ে এগিয়ে আসছে ঝুমকির দিকে।

হঠাৎ ঝুমকি দেখল কাকটা একেবারে উড়ে এসে সোফার উপর বসেছে। বাপরে! কী নাছোড়বান্দা কাক। নাহ, একে থামাতেই হচ্ছে। নাহলে হয়ত প্লেট থেকে পরোটাটাই না তুলে পালায়। ইশ! কী বিশ্রীভাবে ডাকছে। ঝুমকি তাড়াতাড়ি করে প্লেট থেকে একটা মুচমুচে লঙ্কাভাজা তুলে কাক্কেশ্বরকে অফার করল।

আর যায় কোথায়। ওমনি সেটা খপ করে ঠোঁটে করে নিয়ে গিয়ে রেলিং-এর উপর বসে খেতে লাগল কাকটা। যাক বাবা! খাবার পেয়ে চলে গেছে, আর আসবে না। নিশ্চিন্ত হয়ে ঝুমকি পরোটা খেতে লাগল।

কিন্তু একই? লঙ্কাটা খাওয়ার পর কাকটা কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে। তার ঘড়ের পালকগুলো কেমন খঁড়া খাঁড়া হয়ে গেছে। ডানা ঝাপটাচ্ছে। মাথা ঝাঁকাচ্ছে। আর তীব্রস্বরে ডাকছে।

হঠাত ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে ঘরে ঢুকে চারিদিকে উড়ে বেড়াতে লাগল সে। সেই সাথে তীব্র চীৎকার – “ক্কা ক্কা ক্কা ক্কা!”

“ওমা, মাগো! বাঁচাও বাঁচাও!” – বলে ঝুমকি ঘর ছেড়ে দেয় ছুট।

বেশ কিছুক্ষণ পরে ঘরে ঢুকে ঝুমকি আর তার মা দেখে লঙ্কাকাণ্ড করে রেখে দিয়ে গেছেন শ্রীমান কাক্কেশ্বর কুচকুচে। সোফা, চেয়ার টেবিল, আলমারির গায়ে, জামা কাপড় সবকিছুতেই লেগে আছে সাদা সাদা ছোপ। লঙ্কার ঝালের চোটে বেচারার পেট গড়বড় হয়ে গিয়েছিল। 

শ্রীমান কাক্কেশ্বর কুচকুচেকে অবশ্য এরপর আর ঝুমকিদের বাড়ির আশেপাশে দেখতে পাওয়া যায়নি।

পরে অবশ্য ঝুমকি কাক্কেশ্বরকে নিয়ে এক মজাদার ছড়া লিখেছিল। সেটাও দিলাম এখানে-

নাছোড়বান্দা কাকের ছা,
ডাকছে খালি “ক্কখা, ক্কখা”।
চাই কি তোর বল না সেটা।
“ক্কখা ক্কখা একটু ক্কখানা”।
“খানা চাই?” এই নে এটা
মুচমুচে এক লঙ্কা ভাজা।

খপাৎ করে গিলেছে বেটা,
জানিস কি ভীষণ ঝাল ওটা?
কি করলি রে এই হতচ্ছাড়া!
চারিদিকে এ কী সাদা সাদা?
কুকীর্তিটা আমার ঘরে
না করলে চলতো না!



 


Author bio

Name: Sayantani Banerjee

Sayantani Banerjee is by profession a digital marketer and guest blogger and loves to write on various subjects like fashion, lifestyle, digital marketing, psychology, personal development, etc. She writes in Bengali and English language.

View her profiles on LinkedIn | Facebook | Twitter

মন্তব্যসমূহ

এই ওয়েবজিনের জনপ্রিয় নিবন্ধঃ-

বিজ্ঞপ্তি

ছোটদের ফটোগ্রাফি শেখা - পর্ব ১ (শ্যাডো প্লে)

হাড় মজবুত করতে চাও? তাহলে রোজ শশা খাও!

ব্যাং রাজকুমারী - পর্ব ১