লেখিকাঃ- দীপালি ভট্টাচার্য
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পিন্টুর স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবস আজ। পঁচাত্তর বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বড় ধুমধাম। পেরেন্টসরাও আমন্ত্রিত। সেখানে গিয়ে ছেলের ইতিহাস টিচার শুভেন্দুবাবুকে দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গেছিল সীমা। এই কি সেই টেস্টে ইতিহাসে ফেল করা তাদের নব্বই এর ব্যাচের বন্ধু শুভেন্দু? হ্যাঁ, সেই!
শুভেন্দুই এগিয়ে এসে বলল, “তুই সীমা তো?”
“হ্যাঁ,” কোনো রকমে বলল সীমা।
পিন্টু মায়ের কাছে প্রায়ই অ্যাসিসটেন্ট হেড স্যার শুভেন্দু বাবুর কথা বলে। কিন্তু সে যে এই শুভেন্দু তা ভুলক্রমেও ভাবেনি সীমা! কিছুক্ষণ আলাপের পর শুভেন্দুকে তাদের বাড়িতে আসার নিমন্ত্রণ জানায় সীমা, স্বামী অসীম বাবুর পরামর্শে।
আজ সীমা ভারি ব্যস্ত। অসীমবাবু গেছেন বাজারে। আজ যে শুভেন্দু আসছে! পিন্টুও বিকেলে আর খেলতে যায়নি। শুভেন্দু এলো সাতটা নাগাদ। চা স্ন্যাকস এর পর সীমা প্রশ্নটা করেই ফেলল, “আগে বল তুই ইতিহাসের টিচার হলি কী করে? টেস্ট এ ইতিহাসে ডাহা ফেল মেরে আজ তুই ইতিহাসের টিচার!”
শুভেন্দু হেসে বলল, ‘মাধ্যমিক দিয়েই তো তুই চলে গেলি কলকাতা থেকে! কাকু ট্রান্সফার হয়ে গেলেন। তাই তুই জানিস না ঘটনাটা। না হলে বন্ধুরা সবাই জানে, মাধ্যমিকে ইতিহাসে ছিয়ানব্বই পেয়েছিলাম’। সীমা অবাক চোখে বলল, “কীভাবে?”
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সে সময় ইতিহাসে সহজে কেউ ফেল না করলেও বেশি নম্বর পেতে গেলে দক্ষতা লাগত। বেশীরভাগ প্রশ্নই ছিল রচনাধর্মী।
- সম্রাট আকবরের সাথে কাটানো কিছুটা সময় আমার জীবনটাই বদলে দিল!
“মানে?”- বলল সীমা।
অসীমবাবু আর পিন্টুর চোখেও বিস্ময়!
ইতিমধ্যে পিন্টুর দিদি পিঙ্কি এসেও ওদের আসরে যোগ দিল।
“টেস্টের রেজাল্ট হাতে বাড়ি ফিরে বাবার কাছে খেলাম বেধড়ক পিটুনি। ‘ইতিহাসে কেউ ফেল করে!’ মায়ের মুখও গম্ভীর! স্বগতোক্তি করলাম, ‘ইতিহাস যে মাথায় ঢোকে না! মহেঞ্জাদড়ো থেকে স্বাধীন ভারত....কম!’ মা ঠিক শুনলেন, ‘সবাই তো এই সিলেবাসই পড়ছে! পাশও করছে!’
একদিকে ডালহৌসি, ওয়েলেসলি, বেন্টিঙ্ক, স্বাধীনতা আন্দোলন অন্যদিকে মুঘল যুগ, সুলতানি আমল, অশোক, বিন্দুসার, বিম্বিসার! সব ঘেঁটে ঘ!
“বাবা মা আর সিলেবাসের চাপে যখন আমার চিড়েচ্যাপ্টা অবস্থা তখনই আমাকে এসে উদ্ধার করলেন আমার মেজো মামা। একটা আধ খ্যাপাটে লোক। বিয়ে-থা করেছেন। কিন্তু সংসার মামার খ্যাপামি বন্ধ করতে পারেনি। সরকারী উচ্চ পদে কাজ করতেন, কিন্তু ভলানটারি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে বাড়িতে বসে কী সব গবেষণা করছেন! আর মেজো মামির এসবে ভারি প্রশ্রয় আছে! মামি নিজেও একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা।
“মা মাঝে মাঝে মামির প্রতি অনুযোগ করেন, ‘দাদা তো খ্যাপাটে ছিলেনই তোমার প্রশ্রয়ে দাদার খ্যাপামি বেড়েই চলেছে!’ মামি হেসে উড়িয়ে দেন। মামিও তার খ্যাপা স্বামীকে নিয়ে বেশ আছেন।
“ওনাদের নিজেদের কোনো সন্তান ছিল না। ভাইপো ভাইঝি, ভাগনা ভাগনিদের নিয়েই ওনাদের সময় কেটে যায়। আমরা ছোটরাও মেজোর সাথে খুব সহজে মিশতে পারতাম। হ্যাঁ মেজো, আমরা কাকা বা মামা বলতাম না! মেজো বলতাম!
“মেজো দুদিনের জন্য ভাগনাকে মানে আমাকে নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়িতে। সেখানে গিয়ে ছোট মামার ছেলে সুবীরের সাথে দেখা। সেও এবার মাধ্যমিক দেবে! সে ব্যাটা আবার অঙ্ক বিশেষ করে জ্যামিতি, পাটিগনিত পারে না! হেডস্যারের হাতে পায়ে ধরে মাধ্যমিকে বসার অনুমতি পেয়েছে! তার সাথে নাকি মামা দেখা করিয়ে দিয়েছেন কেশব নাগের! যিনি প্রায় তিন বছর আগেই মারা গেছেন! তারপর থেকে সে অঙ্কই কষে যাচ্ছে!
“মামার চারতলা বাড়ি। তিনটি তলা ভাড়া দেওয়া। চারতলায় মামা থাকেন। ছাদে নানারকম অদ্ভুত ধরনের গাছ আছে। যে সব গাছ সহজে দেখা যায় না! এছাড়া কিছু মাংসাশী গাছও আছে! সূর্য শিশির, কলস উদ্ভিদ প্রভৃতি। ছাদের দক্ষিণ দিকে একটা ঘর আছে। সেটি হল মামার বিজ্ঞান ঘর। ঘরের ছাউনি টিনের। ছাউনিটি দরজার পাল্লার মত ভাজ করা। প্রয়োজন মতো সেই পাল্লা দুদিকের দেওয়ালের লাগানো লম্বা দন্ডের সাহায্যে খুলে যায়। তখন মেজো শক্তিশালী দূরবীন দিয়ে রাতের তারা দেখেন, তারাখসা দেখেন! সেই ঘরে মামার কত যন্ত্রপাতি। নানা আকারের বকযন্ত্র। কত রকমের জার। সেই জারে কত রকমের পতঙ্গ। অন্য কতগুলো জারে কীটানু-কীট। অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে সেসব কত বড় লাগে!
“তবে সম্প্রতি মেজো একটা নতুন জিনিস তৈরি করেছেন। একটি কাঁচের গোলক। বেশ বড়। ঘরের মাঝখানে অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে সেই গোলকটি। দেখতে অনেকটা গ্লোবের মতো। কিন্তু গ্লোব নয়। গোলকের দুদিকে দুটি ছোট ছোট পাখা। বাইরে থেকে ভিতর অংশটি পরিস্কার দেখা যায়। ভিতরে দুটি চেয়ার আছে। একটি কাঁচের দরজা। দরজার পাশে কতগুলো সুইচ আছে। বাইরে থেকে সিঁড়ি দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করা যায়। মেজো বলল, ‘ভিতরে গিয়ে বস’।
“আমি সেই গোলকের ভিতর প্রবেশ করে চেয়ারে উঠে বসলাম। মেজো একটি সুইচ টিপলেন! সাথে সাথে এক অদ্ভুত অনুভূতি হল! এক মায়াবী আলো খেলে গেল গোলকের মধ্যে! পরে জেনেছিলাম ওটি নাকি ইতিহাস ঘরের সুইচ। গোলকের মধ্যে ঘরগুলি অদৃশ্য অবস্থায় আছে! এক একটি সুইচ টিপলে এক একটি ঘর খুলে যাবে! মেজো বললেন, ‘কোনো এক ঐতিহাসিক চরিত্রকে স্মরণ কর, যাঁকে স্মরণ করবি তাঁকে তোর উল্টো দিকের চেয়ারে দেখতে পাবি!’ কাকে স্মরণ করব, ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুশাসক মুঘল সম্রাট আকবরের কথা। অদ্ভুত ভাবে আমার সামনের চেয়ারে দেখলাম তাঁকে! চেয়ার নয়, সিংহাসন! সিংহাসনে মহামতি আকবর! আমাদের গোলকটি ঘুরতে শুরু করল! টিনের ছাউনিটি গেল খুলে! গোলকটি ঘুরতে ঘুরতে ছাউনি ভেদ করে বেড়িয়ে এলো অতীত পৃথিবীতে! আমার চোখে ঘোর লেগেছে! মহামতি কথা বলছেন, হিন্দুস্তানি ভাষায়। তিনি বলছেন, ভারতের বৈচিত্র্যের কথা, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের কথা! সুজলা সুফলা ভারতের কথা। সমৃদ্ধশালী ভারতকে শাসনের আশায় বারবার বৈদেশিক আক্রমণ হয়েছে সেই প্রাচীন কাল থেকে!
“তিনি বলছেন, হরপ্পার নগর সভ্যতার কথা, বৈদিক যুগের কথা! বুদ্ধ, জৈন ধর্মের কথা! উত্তর ভারত, দক্ষিণ ভারতের রাজারাজরাদের কথা! আমি যেন দেখতে পেলাম সেই সময়ের ভারতবর্ষকে। তারপর এলো সুলতানী যুগ, মোঘল যুগ। যে সুলতান বা সম্রাটরা বুঝতে পেরেছেন বহু ভাষা ও ধর্মের দেশ ভারতকে শাসন করতে গেলে ধর্মের বিভেদ মুছে ফেলতে হবে, জনকল্যাণকামী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে তাঁরাই সুশাসক হিসেবে গন্য হয়েছেন। এরপর এলো বৃটিশ যুগ। একদিকে যেমন পাশ্চাত্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হলো অন্যদিকে শুরু হলো বৃটিশের অত্যাচার এবং বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন! আমার চোখের সামনে যেন অতীতের পুনরাভিনয় ঘটে চলল! কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম!
“হঠাৎ মেজোর গলা, এই শুভ, শুভ ওঠ! ওঠ।
“ঘোর কাটতেই দেখলাম, আমি ওই গোলকের চেয়ারে বসে আছি আর উল্টোদিকে মেজো!
“বেড়িয়ে এলাম গোলক থেকে! ইতিহাস বইটি খুলে বসলাম। আমার চোখের সামনে তখন অতীত ভারতের পরিষ্কার ছবি ফুটে উঠেছে। টানা পনেরো দিন ধরে ইতিহাস বই পড়ে ইতিহাসের সিলেবাস শেষ করেছিলাম”।
সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলো শুভেন্দুর কথা!
পিঙ্কিই প্রথম কথা বলল, “সেই গোলকটি একবার দেখাবেন স্যার!”
শুভেন্দুবাবু বললেন, “সেটি আর নেই!”
“নেই!” সবাই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল!
- না, মেজোমামি ভেঙে ফেলেছেন!
মেজোমামি ভেঙে ফেলেছেন, একথা শুনে সবাই ভীষণ আশ্চর্য হল।
- হ্যাঁ, আমার আর সুবীরের পনেরো দিন ধরে নাওয়া-খাওয়া ভুলে ইতিহাস পড়া আর অঙ্ক কষা দেখে তিনি খুব ভয় পেয়ে গেছিলেন! তাছাড়া আমরা পনেরো দিন ধরে মেজোর বাড়িতেই ছিলাম! মামিকে সবার কাছে কৈফিয়ত দিতে হচ্ছিল, কাজেই!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন